পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে অর্ক তার ইচ্ছের নিজস্ব জাদুবলে হলঘরের আলোগুলোকে এক নিমেষে নিভিয়ে দিয়ে সভাপতির টেবিলে কয়েকটা রঙিন মোমবাতি জ্বেলে দিল। কি আশ্চর্য! মোমবাতির নরম আলোয় কবিতাগুলো যেন তাদের শব্দ-দেহ ছেড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন প্রজাপতি হয়ে ঘরময় উড়ে বেড়াতে থাকলো।
অর্ক একা একা বসে প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখছে। প্রজাপতির শরীরে
কবিতার শব্দগুলো তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে হলো সেই হলঘরে যেন আর কেউ নেই।
“আছি তো, আমি তো অনেকক্ষণ আগেই এসেছি।”– মঞ্চের অন্যপাশে কালো পর্দার ওপারে থেকে একটি
ছেলের গলা শোনা গেল। সেই শব্দে সমস্ত নিস্তব্ধতা
ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পাতা পড়ার শব্দে ঝরে পড়ছে। ঘরের সমস্ত আলোগুলো আবার জ্বলে উঠতেই প্রজাপতিগুলো কোথায় যেন
নিমেষে হারিয়ে গেল।
ততক্ষণে কবিদের কবিতা পাঠ শেষ। সম্মিলিত হাততালির সাথে, সামান্য একটু দেরীতে, পর্দার ওপার থেকে আরো
দু’জোড়া হাততালি জুড়ে গেল। সঙ্গে চাপা স্বরে কথোপকথন –
“অনুষ্ঠান শুরুর আগে আপনিই ফোন করেছিলেন?” – সেই ছেলেটির গলা।
“হ্যাঁ, আসলে এখানের ঠিকানাটা ঠিক জানতাম না।”
মেয়েটির গলা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। অর্ক পেছন ফিরে তাকাল। দেখল, মেয়েটি পর্দা একটুখানি সরিয়ে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে
আছে।
“আমাকে জানাতে পারতেন। আমি বাসস্ট্যান্ড থেকে
আপনাকে নিয়ে আসতাম...” – ছেলেটি বলল।
“না-না...আমি শুধু জায়গাটা চিনতে পারি নি।”
“আপনাকে আগেও দেখেছি। সমস্ত কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানেই
আপনি আসেন। আমি অয়ন।”
পর্দার ওপারে তাদের নড়াচড়া ছায়াদৃশ্যের পুতুলনাচের মতো লাগছে। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্যে কিন্তু মেয়েটির চোখ হলঘরের দিকে নিবদ্ধ। একজোড়া চঞ্চল চোখ যেন কাউকে খুঁজছে, তন্নতন্ন
করে খুঁজছে।
**
বেশ কিছুক্ষণ পরে অনুষ্ঠান শেষে সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খোশগল্পে
মশগুল। শ্রোতারা কেউ কেউ তাদের প্রিয় কবির সাথে পরিচয় করছেন। কেউ তাঁদের অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। প্রতিটি মানুষের মুখে এক প্রশান্তির
উজ্জ্বলতা।
অর্ক চুপিসারে ভিড় এড়িয়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো। এক কাপ উষ্ণ চায়ের জন্য
বড্ড আনচান করছে। এক হাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে অন্য হাতে সিগারেটে আগুন ধরানো মাত্র
সেই মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল।
“আপনি আজ একটিমাত্র পড়লেন কেন? আগে প্রত্যেকবারই অনেকগুলি কবিতা পড়েছিলেন।”
“হুঁ”, দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা অহেতুক
পুড়ছে। এইসময় অর্ক কথা বলতে চায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে
বেশ মৌজ করে ধোঁয়াটাকে মগজে চালান করে দেওয়া মাত্র একটা আনন্দ এসে তাকে জাপটে ধরে। বিশেষ করে গরম চায়ের কাপে চুমুক দেবার পর পরই।
মেয়েটি মনে হয় কিছুটা বুঝল। বলল, “আপনার অপ্রস্তুত হবার কিছু নেই। আমি এখানেই আছি।”
“আপনি চা খাবেন?” - এটুকু না বললে নেহাতই অভদ্রতা
হয়।
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে না বোঝাল। বলল, “আপনি বাড়ি ফিরবেন কখন?”
“একটু পরেই যাবো। আপনি কোনদিকে?”
“লেকগার্ডেন্স।”
“আমি টালিগঞ্জ যাবো।”
বলামাত্র মেয়েটির চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
অর্ক অবাক চোখে তার দিকে তাকাতেই মেয়েটি বলল, “আপনি কিচ্ছু বোঝেন না। তাই মুখ ফুটে বলতে হয়। আমাকে একটু বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন?”
অর্কের মনে হলো মুহূর্তেই তার চারপাশে যেন শত সহস্র আলো জ্বলে উঠল। আরে! এতো আলো তো মঞ্চের হলঘরেও ছিল না।
অর্কের মনে হলো এক্ষুনি আর একটা সিগারেট ধরানো দরকার, আগেরটার থেকে আগুন ধার করে।
২৮ মার্চ, ২০১৬
কলিকাতা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন