দিবস-মোহ


বারো মাসে তেরো পার্বণছাড়িয়ে এখন বছরের প্রতিটি দিনই হয় কোন দিবস কিংবা উৎসব। গতকাল শিশুদিবস ছিল, আজ ক্যান্সার দিবস কিংবা আগামীকাল উপভোক্তা দিবস উদযাপন করা হবে। অথচ নারীদিবসের দিনেই মধ্যপ্রদেশের একজন স্বামী (?) তার স্ত্রীকে দাঁড়িপাল্লায় তোলেন ঋণ পরিশোধ করার জন্য কিংবা দেশের একাধিক মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবীতে পথে নেমে আন্দোলন করতে হয় নারীদের অন্যদিকে পরিবেশ দিবসের দিন নামকরা বহুজাতিক সংস্থার “বায়ুশোধনকারীযন্ত্রের বিজ্ঞাপন ঝলমল করে ওঠে স্বল্পবাস পরিহিতা নায়িকাদের ছবিতে

আসলে আমাদের এই ‘ভোগবাদীসমাজে এইসব দিবসের পালনের সাথে সমাজের সার্বিক কল্যাণ জড়িয়ে থাকে নামমাত্র। বিনা খরচে কেউ ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা করার অঙ্গীকারও করে না। একটি ‘বিশেষ’ দিবস, সে ‘শিশু দিবস’ কিংবা ক্যান্সার দিবস’ হোক না কেন, সেই দিনটি আসলে ব্যবহৃত হয় আরো বেশী বেশী পণ্য বিক্রি করার একটা ‘বিশেষ’ সুযোগ হিসাবেসর্বক্ষন, সর্বত্র শুধু বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপনএক দল বলে ‘কিনে নিন, কিনে নিনতো অন্য দল বলে বেচে দিন, বেচে দিনআচ্ছা, আমরা কি কলের পুতুল না লাঙ্গলে জুতে দেওয়া বলদ!

একটি “দিবস পালন” আসলে সমাজ কিংবা মানুষের প্রতি পূর্বকৃত অঙ্গীকারকে মনে করিয়ে দেওয়া। অথচ বাস্তবে এগুলো পর্যবসিত হয় জনগনের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার কৌশলি প্রচেষ্টা হিসাবেব্যক্তি, সমাজ থেকে শুরু করে আমাদের চিন্তা, চেতনা, মনন ও ভাবনাকে সবসময় কিছু-না-কিছু একটা প্রলোভনের সাথে “খুড়োর কলেরমতো জুতে দেওয়া চাই

ঘুম থেকে উঠলেই একটি দিবসআমি-আপনি সারাদিন ধরে সেই দিবস পালনে মত্ত। এটাই পুঁজিবাদী বাজারীব্যবস্থা আর সেই ব্যবস্থা ময়াল সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে গিলে ফেলতে চায় দেশ, সমাজ, সংসার, সম্পর্ক। সব কিছুজাতি-ধর্ম-বয়স নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা সহ গোটা সমাজটাই যেন একজন মাতাল আর তার পাশে মদের খালি বোতলের মতো দিন-রাত গড়াগড়ি খাক। আমাদের মন-মস্তিষ্ক, চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়া সমস্ত কিছু আবর্তিত হোক এবং নিমজ্জিত থাকুক কোন না কোন পণ্যের ভোগবিলাসিতায় অথবা ভোগ্যপণ্যের আকাঙক্ষায়।

তাই মনে হয় না এবার নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ সবাইকে এই দিবসপালনের মোহ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার? পিতা-মাতা দিবস পালন করার পরেও বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেলের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আদালতের দারস্থ হতে হয়। ঘটা করে শিশুদিবস পালন করার পরে শিশুশ্রমিকের বানানো চা না খেলে চায়ের স্বাদ পাওয়া যায় না। আবার নারীদিবসের বক্তৃতা মঞ্চ থেকে মাইকের শব্দ পিঠে শিশু সন্তানকে বেঁধে ইঁটভাটায় ইঁট বইতে থাকা নারীর কানে পৌঁছয় না। কোন বিশেষ দিবস যেমন আমাদের মহৎ করে তোলে না, তেমনি পতনোন্মুখ মানসিকতা কিংবা চারিত্রিক ত্রুটিকেও পাল্টাতে পারে না। পারবেও না। যতক্ষন না আমাদের কোন গঠন মূলক ও উন্নততর সমাজব্যবস্থায় আমাদের উত্তরণ হবে।

কোন মন্তব্য নেই: