নতুন দেশে বেড়াতে
গিয়ে মানুষ চিনতে হলে অনেকেই স্থানীয় কাগজে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়েন। ওই বিজ্ঞাপনের ভাষার মধ্যে কিছুটা
হলেও খুঁজে পাওয়া যায় সে দেশের মানুষের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা। সাথে মুখদর্শন হয় সমাজ-চরিত্রের।
এদেশে,
সকালে কাগজ খুললেই একদলা কাদা-পাঁক মুখের উপর ছিটকে এসে পড়ে। কি সেই
সমাজ-চিত্র! ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু হয় হিংসা, রক্তপাত আর
কিছু নরাধমের ইতরামির সচিত্র বিবরণ পড়ে। কাগজের পাতায় পাতায় শুধু ‘মুঠোভর্তি’
ক্ষমতা দখলের নির্লজ্জ এক সমাজের ছবি। এক-আনা ক্ষমতায় দু’আনা অর্থ হাসিল। সেই দু’আনা
অর্থে আট-আনা ক্ষমতা কেনা চাই। শুধু চক্রাকারে বাড়তে থাকে লোভ আর কমতে থাকে জীবনের
দাম। কেউ ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে হিসেব বুঝে নিতে চায় আর কেউ উচিত শিক্ষা দেবার জন্য ঘরে
লোক ঢুকিয়ে দেবার হুমকি দেয়।
নিহতের রক্ত
মাটি চেটেপুটে খায়। রক্তবীজ বাতাসে ওড়ে। একের পর এক বিষবৃক্ষ আকাশে মাথা তুলতে
থাকে। শত-সহস্র বছরের জিন-লালিত উত্তরাধিকার আমাদের। আর সেই সুযোগে আসুরিক
চেহারাগুলো হিংস্র দাঁত-নখ বার করতে থাকে দিনের আলোর তোয়াক্কা না করেই। ফলে মোষ
চুরির মিথ্যে অপবাদ নিয়ে ‘তাজা’ যুবক গণধোলাই হজম করতে পারে না। চোরকে চিনে ফেললে
গৃহস্থের ঠাঁই হয় শ্মশানে। আবার হোটেলে খাবার শেষ হয়ে গেলে দোকানী মাছের ঝোলে সেদ্ধ
হতে থাকে।
মনস্তত্ত্ববিদেরা
হয়তো এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাশবিক ফল্গুধারা খুঁজে পাবেন। অথচ একটু লক্ষ্য করলেই খুঁজে
পাওয়া যাবে তার নীল-নকশা। সামাজিক বাঁধুনি আর আইনের ভয় -
এরা বহুদিন ধরেই নিখোঁজ। আপনি রাজনৈতিক নেতা হয়ে পুলিশকে টেনে
থাপ্পড় মারলেও হাজতবাস তো দূরের কথা - গায়ে আঁচড়টুকু পড়বে না। দুর্ভাগ্যক্রমে,
গুরুতর অভিযোগে গারদে ঠাঁই হলেও হর্তাকর্তারা সদলবলে থানায় চড়াও হয়ে
আপনাকে ঠিক ছাড়িয়ে নিয়ে আসবে। খুনের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জামিনে ছাড়া পেলে থানার
বাইরে ফুলের মালায় সংবর্ধনা পাবেন। সেই সমাজে “হুমকি
সংস্কৃতির” রমরমা হবে না তো কোথায় হবে? সে যতই আপনি রাস্তার মোড়ে মোড়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনুন। ঘুণধরা সামাজিক
চরিত্রের পচাগলা দেহ থেকে দুর্গন্ধ আটকানো যায় কি!
এর পাশাপাশি
অন্য চিত্রও আছে। বেশ কয়েকদিনের খবরের কাগজ উল্টে দেখলে ছোট ছোট কলামের কিছু খবর –
যেগুলো অনেক সময় চোখে পড়ে না। এখনো চিত্ত যাদের ভয়শূন্য আর শির যাদের উঁচুতে
- সেই আদালতের কয়েকটি বিশেষ রায় দেখা যাক। কি হাইকোর্ট, কি সুপ্রীম কোর্ট। এক যুগ ধরে রাজ্য সরকারের বাহানায় যে অস্থায়ী কর্মীদের
স্থায়ী চাকরিতে বহাল হওয়া আটকে ছিল, আদালত সেই দপ্তরের
সচিবকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে পারেন ভেবেই তিনি সুড়সুড় করে আদালতে এসে কর্মীদের নিয়োগপত্র দিয়ে
যেতে বাধ্য হয়েছেন। বিনা লাইসেন্স আর বেআইনি গাড়ীর রাশ ঠেকাতে আদালত বলতে বাধ্য
হয়েছেন, না পারলে বলুন, আদালত ব্যবস্থা
করবে। উত্তর ভারতে এক (অ)বিখ্যাত শিল্পপতি বছরখানেক ধরে তিহার জেলের ঘানি টানছেন
লক্ষ লক্ষ আমানতকারীকে সর্বস্বান্ত করার দায়ে। অন্য এক ‘মাছরাঙা’ শিল্পপতি ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ না করে গ্রেপ্তারীর ভয়ে বিদেশে গিয়ে ইঁদুরের
গর্ত খুঁজছেন।
এই দু’টো চিত্র পাশাপাশি রাখলে একটা অনন্ত হতাশার শেষেও আলোকবিন্দুর মতো একটা সত্য
ঠিক্রে বেরিয়ে আসে। সেটা হলো, এদেশের বিচারব্যবস্থার উপর এখনো ভরসা করা যায়। এখনো
আমরা আশায় বুক বাঁধতে পারি এই ভেবে যে এত ‘কালাপাহাড়ী’ অন্যায়, মানবাত্মার এত অপরিসীম লাঞ্ছনা, সততার এত দ্রুতগামী অধঃপতন
দেখা সত্ত্বেও মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে এদেশের মহামান্য আদালত দেশবাসীকে সামনে থেকে
নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রতিদিন আমাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় কারণ একটি দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী
বিচারব্যবস্থাই পারে এই “হুমকি সংস্কৃতির” বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে।
কোটি-কোটি মামলা
আদালতে পড়ে আছে। বিচারের বাণী আজও নিভৃতে কাঁদছে অগুণতি মানুষের জীবনে আর সংসারে। পড়ে থাকা এই পর্বতপ্রমান মামলাই ন্যায়বিচার পাবার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে বিরাট বাধা। সর্বোচ্চ ন্যায়াধীশের মতে
এখনই আরো ৭০০০০ বিচারক প্রয়োজন। যদিও এই অবস্থা একদিনে তৈরী হয় নি।
তাহলে কেন হয়েছে?
তাহলে কেন হয়েছে?
এই প্রশ্নের
ভেতরেই লুকিয়ে আছে সমস্যার প্রাণভোমরা। একটু ভাবলেই এদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আর
তার নেতৃত্বের মূল চরিত্রটি বইয়ের খোলা পাতার মতো সহজেই পড়া যায়।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের নেতৃত্ব,
শাসনব্যবস্থা এবং সর্বোপরি সরকার - কেউ কি এগুলো খেয়াল করে নি? অবশ্যই খেয়াল করেছে। পাশাপাশি এটাও খেয়াল করেছে সময় যত এগোচ্ছে, আদালতের উপর দেশের জনগনের আস্থা দিন দিন বাড়ছে। কারণ সমসাময়িক প্রতিটি
ক্ষেত্রে যেখানে বিচার শেষে রায় ঘোষণা হয়েছে সেখানেই সামাজিক ও মানবিক ন্যায়
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
‘ন্যায়প্রতিষ্ঠিত সমাজ’ সমস্ত রাজনীতির কারবারীদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। তারা ঘোলা জলে মাছ ধরতে অভ্যস্ত। আইন তৈরীর সময় লখীন্দরের ঘরে ছিদ্র তৈরী করে রাখে। পুলিশকে নিধিরাম সর্দার বানিয়ে, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে ছাপ্পা ভোট দিয়ে ক্ষমতা দখলে রাখতে চায়। তারা জানে ক্ষমতা রাখতে জনগনকে ভয় খাওয়াতে হবে, গুণ্ডা পুষতে হবে। দাবহোলকার, পানসারে ও কালবুর্গির মতো লেখক ও যুক্তিবাদীদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে হবে। তখন মনে হয় না, রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর কিংবা বালগঙ্গাধর তিলক বেঁচে থাকলে তাঁদের আজ কি পরিণতি হতো?
অপরাধীরা আদালতে
শাস্তি পেলে, দেশে ন্যায়ব্যবস্থা
শক্তিশালী হলে আখেরে সেইসব রাজনীতিকদেরই ক্ষতি। অবিসম্বাদিত ক্ষমতা না থাকলে,
সীমাহীন সম্পদের মালিকানা হাতে না পেলে, তথাকথিত
ভোগবাদী সমাজে রইলটা কি!
তাই আদালতকে
যতটা সম্ভব ঠুঁটো করতে রাখতে পারলে এদেশের ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ - বৃহৎ মালিকানার পুঁজিবাদ ও
নীতিবোধশূন্য রাজনীতির পোয়া বারো। তারা জনগনের আঙুলের ছাপ কেড়ে নিয়ে ক্ষমতাবান হতে
পারে। ‘চুটকি’ মূল্যে তাদের শ্রমকে কিনে বে-লাগাম মুনাফা করতে পারে। দেশের প্রাকৃতিক
সম্পদকে নিজেদের কুক্ষিগত করতে পারে। স্বাধীন মতাদর্শকে দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে
হত্যা করার ফন্দি করতে পারে। শেষমেষ কলম কেড়ে নিতে না পারলে তাকে ‘একলব্যের’ দলে
ছুঁড়ে ফেলতে পারে।
তাহলে আমরা কি সেইসব মহিষাসুরদের বধ করার জন্য নতুন করে দেবতাদের উপর ভরসা করবো? না আমরা নিজেরাই একে অন্যের সাথে হাত মিলিয়ে এক মানবশৃঙ্খল তৈরী করবো। মহিষাসুরের দল একবার যদি সেই শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে, তখন সবুজ কচি ঘাস খাওয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকবে না।
1 টি মন্তব্য:
সভ্যতার এত বছর পরেও অধিকাংশ মানুষ দৃষ্টিহীন । এই দৃষ্টিহীনদের চোখে আলো ফোটাবার হাজার চেষ্টা বিফল করার জন্য রয়েছে একটি লোভী,খুদ্রমনা শ্রেণি। আশা করি এই লেখা পড়ে সেই দৃষ্টিহীনেরা পাক আলোর সন্ধান,হোক সচেতন, দেখুক নতুন সূর্যকে ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন