প্রদীপের নীচে ‘আলো’


আবার চৈত্রমাস। আবার সর্বনাশ। আমাদের মতোই কারো ঘরে, সংসারে। দিল্লির অভিসার সিনেমা হল, পার্কস্ট্রীটের স্টিফেন কোর্ট, ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতাল আর সর্বশেষ বিবেকানন্দ উড়ালপুল। শুধু ‘সাধারণ’ মানুষের অবিশ্রান্ত মৃত্যুমিছিল। দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ, থেঁতলানো মাংসপিন্ডের মধ্যে মিশে থাকা ‘সাধারণের’ দেহ। তার সাথে মিশে থাকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ঘর-সংসার, প্রেম-ভালোবাসা আর পরিবারের হৃদয়বিদীর্ণ আর্ত হাহাকার।
 
আর মৃত্যুযন্ত্রনার আর্তনাদে বাতাস যখন ভারী হয়ে এসেছে, কপোল বেয়ে অশ্রুধারা যখন কিছুতেই শুকোবে না বলে জেদ ধরেছে, তখন রাজনৈতিক নেতাদের খামচাখামচির
চিল-চিৎকারে কান পাতা দায়। নির্মাণকারী সংস্থা উত্তুঙ্গ স্পর্ধায় হুঙ্কার ছাড়ে, ‘সবই ভগবানের দোষ’। তবু এই ‘জনসাধারণের’ রক্ত ধমনী ফেটে বেরিয়ে আসতে চায় না! শুধুমাত্র ‘বেঁচে থাকার অভ্যাসে বাঁচা’ – এই মানুষদের তারা যখন ইচ্ছে সিনেমাহলে, হাসপাতালে পুড়িয়ে কিংবা সেতু দিয়ে পিষে মারতেই থাকবে? আমার নয়, অন্যের দায় বলে পিংপং খেলতে থাকবে আর বলবে, তোমাদের রক্ত দরকার নেই, আমাদের রক্ত মজুত আছে। তখনও কি মাথার শিরাগুলো দপদপ করে চেঁচিয়ে উঠবে না, ‘আর নয়, এবার ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো’!

শাসকেরা ধর্ম দিয়ে ভাগ করেছে, রাজনীতি দিয়ে ভাগ করেছে, গাত্রবর্ণ-জাতি-পেশা দিয়ে ভাগ করেছে আমাদের প্রেম, বিশ্বাস, ভালোবাসা, স্বাধীনতা। এবার ‘রক্তের জাত’ নিয়েও কথা তুলছে। তবু এরা মুখোশের আড়ালেই থেকে যাবে! নিজেরা আর কত খন্ডিত-বিখন্ডিত হবেন। এবারেও কি একবার চেঁচিয়ে বলতে পারেন না, আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই।

এতকিছুর মাঝেও তবু আমরা হতাশ হতে শিখিনি। কেন? যখন দেখি প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কোথা থেকে যেন হাজারে হাজারে দেবদূত নেমে আসে। সেই দেবদূতেরা আহতদের কাঁধে তুলে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। কেউ এক ফোঁটা জল গলায় ঢেলে দেয় শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে কিংবা উষ্ণ হাতে তুলে নেয় নিথর হয়ে যাওয়া হাত। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ গ্রীষ্মের চাঁদিফাটা রোদ্দুর উপেক্ষা করে লাইন দেয় হাসপাতালের সামনে রক্তদানের জন্য।

এই দেবদূতেরা নিঃশব্দে আসে, আবার নিঃশব্দে চলে যায়। আমাদের যন্ত্রণায় মমতার পরশ দেয়, ক্ষতে লাগিয়ে দেয় বিশল্যকরণি কিংবা মুখে তুলে দেয় মৃতসঞ্জীবনী। সর্বত্রই শুধু ভগবানের ছবিতে ছয়লাপ। আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা কি এই দেবদূতদের ছবি তুলে আমাদের দেখাতে পারেন না! তাদের ছবি দেখি আর না দেখি, আমার এই ক্ষুদ্র গৃহকোণ থেকে তাদের শতকোটি প্রণাম জানাই।

কোন মন্তব্য নেই: