আলাপ


দর্শকভর্তি হলঘরের মঞ্চে কবিরা একটার পর একটা কবিতা পড়ে চলেছেন যেন একটু আগেই পৃথিবী জন্ম নিয়েছে। কারণ পৃথিবীতে যে কোন প্রান্তে যখনই কোন কবিতা পড়া হয়, তখনই একটি করে নতুন জগতের জন্ম হয়। আবেশমুগ্ধ শ্রোতাদের মৃদু হাততালি যেন উচ্চারিত কবিতার শব্দগুলোকে সরোদের পাশে তানপুরার মতো সঙ্গত দিচ্ছে  

পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে অর্ক তার ইচ্ছের নিজস্ব জাদুবলে হলঘরের আলোগুলোকে এক নিমেষে নিভিয়ে দিয়ে সভাপতির টেবিলে কয়েকটা রঙিন মোমবাতি জ্বেলে দিল কি আশ্চর্য! মোমবাতির নরম আলোয় কবিতাগুলো যেন তাদের শব্দ-দেহ ছেড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন প্রজাপতি হয়ে ঘরময় উড়ে বেড়াতে থাকলো

অর্ক একা একা বসে প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখছে প্রজাপতির শরীরে কবিতার শব্দগুলো তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে হলো সেই হলঘরে যেন আর কেউ নেই

বিশুদ্ধ বাতাস

হাঁপানির মানুষেরা ভোরে কাক ডাকার অপেক্ষায় থাকে। দু’একটা কাক ডেকেছে কি ডাকে নি তার আগেই সুজাতাদেবী বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আঃ, কি শান্তি। বাড়িতে পাঁচিল ঘেরা এই এক ফালি জায়গাটুকু আছে বলেই মনে হয় আরো কিছুদিন বাঁচা হবে। সুজাতাদেবী আকাশের দিকে তাকালেন। এবার, দূরে পূর্ব কোণে একটু কমলা রঙের আভাস দেখা দিয়েছে। পাঁচিলের বাইরে জাম গাছে পাখিগুলো সবে আড়মোড়া ভাঙছে হয়তো। 

তখনই সুজাতাদেবীর চোখ গেল বাগানের পাঁচিলঘেঁষা ছোট্ট ঘরটার দিকে। এখনো আলো জ্বলছে কেন? সুজাতাদেবী একেবারে ক্ষেপে গেলেন। লোকটার কি কোনদিন আক্কেল হবে না? নয় নয় করে বছর পাঁচেক পেরিয়ে গেল পেনশন পাচ্ছেন। তবু আধ-পাগলামিটা গেল না।

মহিষাসুর

নতুন দেশে বেড়াতে গিয়ে মানুষ চিনতে হলে অনেকেই স্থানীয় কাগজে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন পড়েনওই বিজ্ঞাপনের ভাষার মধ্যে কিছুটা হলেও খুঁজে পাওয়া যায় সে দেশের মানুষের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা। সাথে মুখদর্শন হয় সমাজ-চরিত্রের। 

এদেশে, সকালে কাগজ খুললেই একদলা কাদা-পাঁক মুখের উপর ছিটকে এসে পড়ে। কি সেই সমাজ-চিত্র! ঘুম থেকে উঠে দিন শুরু হয় হিংসা, রক্তপাত আর কিছু নরাধমের ইতরামির সচিত্র বিবরণ পড়ে। কাগজের পাতায় পাতায় শুধু ‘মুঠোভর্তি’ ক্ষমতা দখলের নির্লজ্জ এক সমাজের ছবি। এক-আনা ক্ষমতায় দু’আনা অর্থ হাসিল। সেই দু’আনা অর্থে আট-আনা ক্ষমতা কেনা চাই। শুধু চক্রাকারে বাড়তে থাকে লোভ আর কমতে থাকে জীবনের দাম। কেউ ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে হিসেব বুঝে নিতে চায় আর কেউ উচিত শিক্ষা দেবার জন্য ঘরে লোক ঢুকিয়ে দেবার হুমকি দেয়।

নবদিগন্তের অভিমন্যুরা

লোকে বলে SDF সরকারি নাম নবদিগন্ত। কলকাতা মহানগরীর পূর্ব প্রান্তে দিগন্ত বিস্তৃত এক লবণাক্ত জলাভূমিতে গড়ে উঠেছে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। প্রতি বছর হাজার হাজার তরুণ-তরুণী সেইসব সফটওয়্যার কারখানায় চাকরি শুরু করে। তারপর “কেরিয়ার” নামের অদৃশ্য সাপ-লুডো খেলায় খেলতে নেমে তারা কেমন থাকে ? পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে তারা কোথায় একটা যেন পৌঁছতে চায়। এদিকে চাকরির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে জীবনের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই। দিবারাত্র নিজেদের নিংড়ে দেবার পরে অন্য কোনো সত্তা যে আদৌ বেঁচে আছে, সেটাও বুঝতে পারে না। তবু ভালোবাসা আসে। প্রেম, প্রিয়জন, পরিবার, সবাই অপেক্ষা করে 


পৃথিবীর বহুজাতিক ধনকুবের কোম্পানীগুলো সারা পৃথিবী ছেঁচে তাদের “উন্নত” মস্তিষ্কগুলোকে অঢেল অর্থ দিয়ে কিনে নিয়েছে অর্থ আর স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে আমাদের নবীন প্রজন্মের সোনার ছেলেমেয়েরা কি দিনের পর দিন নিজেদের বিক্রি করে চলেছে ? নিজেদের স্বপ্ন, আশা, চাওয়া-পাওয়া সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে সেই মুনাফা তৈরির কারখানার এক একটি নাটবল্টু হয়ে বেঁচে থাকাটাই হয়তো এ যুগে সাফল্যের মাপকাঠি। কে জানে !


নবদিগন্তের আধুনিক টেকনোক্র্যাট শ্রমিকেরা কি কাজ করে ? কেমন থাকে তারা। তারা কি স্বপ্নের সিঁড়ি দেখতে পায় ? দু-হাতে আঁজলা ভরে অর্থ উপার্জন করলেই কি জীবনের সমস্ত সুখ-আনন্দ-ইচ্ছেপূরণ-আকাঙ্খা তাদের কাছে আপনা-আপনি এসে ধরা দেয়

সত্যিই কি তাই ! কি ভাবে ? সেখানে কি জীবনের সমস্ত রঙ ধরা দেয় ? নাকি সেইসব রঙ রামধনুর মতোই ক্ষণস্থায়ী? নাকি মরীচিকার মতো তাদের টেনে নিয়ে যায় গভীর প্রাণহীন এক মরুভূমির কেন্দ্রে ? নাকি চোরাবালিতে পা ডুবে যায় ধীরে ধীরে। নিজেদেরই অজান্তে। হয়তো তারা সেই ভাগ্যান্বেষীর দল, যারা আরো একটু ভালো জীবনের খোঁজে জীবনযুদ্ধে নেমেছে, যারা দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহে প্রবেশের কৌশল জানে কিন্তু নিষ্ক্রমণের পথ খুঁজে না পেয়ে নিজেদের অবচেতনেই একসময় অভিমন্যুর চরিত্রে পর্যবসিত হয়।
 

বোতলবন্দী

পটল, ধেনো, পাত্তি, ল্যাংড়া, চুন্নু - নামগুলোকে বেশ চেনা চেনা লাগছে না! একদম ঠিক ধরেছেন। এদের যেমন বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, তেমনি অপরাধ জগতেও এই নামগুলো অতি পরিচিত। অনেকটা গরুর গায়ে এঁটুলির মতো সম্পর্ক।

তবে বেশীর ভাগ সময়ে এই নামগুলো জলহস্তীর মতো শুধু নাকটুকু জলের বাইরে থাকে, বাকিটা সুপ্ত। অন্ধকারের জীব। ব্যাতিক্রম, শুধুমাত্র ভোটের সময়টুকু। তবে অন্যসময় ওই যে নাকটুকু বেরিয়ে থাকে তাতেই জনজীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। 

এরা সর্বত্রগামী। সকাল বেলায় রাস্তা কিংবা গলির মোড়ে। বেলা বাড়লে সব্জি বাজারের এক কোণায় একখানা ক্যারামের টেবিলের চারপাশে মাছিদের মতো ভনভন করে। বিকেলে সূর্যদেব বিশ্রামে গেলেই ভাঙা লাইটপোষ্টের নিচে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর একটু বেশী রাত হলে হয় অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধ ছড়ানো নালার গা ঘেঁষে চুল্লু মদের দোকানের পাশে গড়াগড়ি খায় আর নয়তো কারো সর্বনাশ করার ধান্দা খোঁজে।

প্রদীপের নীচে ‘আলো’


আবার চৈত্রমাস। আবার সর্বনাশ। আমাদের মতোই কারো ঘরে, সংসারে। দিল্লির অভিসার সিনেমা হল, পার্কস্ট্রীটের স্টিফেন কোর্ট, ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতাল আর সর্বশেষ বিবেকানন্দ উড়ালপুল। শুধু ‘সাধারণ’ মানুষের অবিশ্রান্ত মৃত্যুমিছিল। দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ, থেঁতলানো মাংসপিন্ডের মধ্যে মিশে থাকা ‘সাধারণের’ দেহ। তার সাথে মিশে থাকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ঘর-সংসার, প্রেম-ভালোবাসা আর পরিবারের হৃদয়বিদীর্ণ আর্ত হাহাকার।
 
আর মৃত্যুযন্ত্রনার আর্তনাদে বাতাস যখন ভারী হয়ে এসেছে, কপোল বেয়ে অশ্রুধারা যখন কিছুতেই শুকোবে না বলে জেদ ধরেছে, তখন রাজনৈতিক নেতাদের খামচাখামচির

দিবস-মোহ


বারো মাসে তেরো পার্বণছাড়িয়ে এখন বছরের প্রতিটি দিনই হয় কোন দিবস কিংবা উৎসব। গতকাল শিশুদিবস ছিল, আজ ক্যান্সার দিবস কিংবা আগামীকাল উপভোক্তা দিবস উদযাপন করা হবে। অথচ নারীদিবসের দিনেই মধ্যপ্রদেশের একজন স্বামী (?) তার স্ত্রীকে দাঁড়িপাল্লায় তোলেন ঋণ পরিশোধ করার জন্য কিংবা দেশের একাধিক মন্দিরে প্রবেশাধিকারের দাবীতে পথে নেমে আন্দোলন করতে হয় নারীদের অন্যদিকে পরিবেশ দিবসের দিন নামকরা বহুজাতিক সংস্থার “বায়ুশোধনকারীযন্ত্রের বিজ্ঞাপন ঝলমল করে ওঠে স্বল্পবাস পরিহিতা নায়িকাদের ছবিতে

ছোবল

ভোট-নাট্য শুরু। আলুর দাম ঊর্ধ্বগামী। পেঁয়াজের কান্না কাঁদতে হবে ভোটের পরে। যে মজুতদারেরা ভোটের খরচ জোগাচ্ছেন তারা যে ত্যাগ ধর্মে বিশ্বাসী নন, হাড়েহাড়ে জানেন। কিন্তু নিরুপায়। হাঁড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ছাগলেরও কিছু করার থাকে না।

ভবিষ্যত নিধির কর বিতর্কে সরকার পিছু হটেছে। অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তৈরী করে, মেরুকরণের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও জনগনকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাতাসে ছড়ানোর পরেও জনগনের নাভিশ্বাস উঠছে না। দেশপ্রেমের ধুয়ো তুলেও ছাঁচ-বন্দী ‘দেশপ্রেমী’ বানানো গেল না। শেষমেশ মুদ্রাস্ফীতির হার কমেছে, এই অজুহাতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সুদের হার এক ঝটকায় অনেকটা কমিয়ে জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের পালটা ছোবল মেরেছে।