তেমনই একদিন একটা
মাথার চুলের ক্লিপ নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে সেটা দু’টো আঙুলে চেপে ধরতেই সে চিৎকার
করে কান্না জুড়ে দিল। তার মা পড়িমড়ি করে ছুটে এল রান্নাঘর থেকে। ততক্ষণে শক্তপোক্ত
ক্লিপের দাঁড়াগুলো ছোট্ট কচি আঙুলে চেপে
বসে গেছে। মা এসে ক্লিপটা খুলে দেওয়ালে ছুঁড়ে দিতেই সেটা ভেঙে দু'টুকরো
হয়ে গেল। সাথে সাথে আমার দিকে উড়ে এল বাক্যবর্ষণ। একটু খেয়াল রাখতে পার না বাচ্চা
মেয়েটার দিকে?
আসলে আমি মেয়ের কাছেই
বসেছিলাম। মেয়েকে প্রতিদিনই ওরকম শাড়ি, স্কুলের ব্যাগ, ক্লিপ, ছাতা নিয়ে খেলতে দেখতাম। সে ফিরে ফিরে আমার
দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতো। আমার খুব ভালো লাগত। আসলে সারাদিন মা স্কুলে থাকার
সময় মেয়েটা তো মাকে কাছে পায় না। তাই হয়তো মায়ের ব্যবহৃত জিনিসগুলোকে নিজের শরীরের
সাথে লেপ্টে রেখে সে হয়তো মায়ের গন্ধটাকে কাছে পেতে চাইত। হারিয়ে যাওয়া
সান্নিধ্যের উষ্ণতাটুকু অনুভব করতে চাইতো। কিন্তু ওই অতটুকু বাচ্চা কি করে জানবে
যে ক্লিপের মতো একটা ভয়ঙ্কর কাঁকড়াও মায়ের চুলে আটকানো থাকে।
আমি ভাঙা ক্লিপটাকে
নিয়ে পাশের ঘরে চলে এলাম। এতদিন ঠিক লক্ষ্যই করিনি যে একটা ছোট্ট ক্লিপের কি অপার
মহিমা। এত কোটি কোটি মসৃণ, সূক্ষ্ম, কয়েকহাত লম্বা চুলকে
কি অসামান্য দক্ষতায় আটকে রাখে। অবাধ্য খুচরো চুলকে চোখের সামনে নাচানাচি করতে দেয়
না। হাওয়ায় আপনমনে উড়তে চাওয়া চুলেরা ক্লিপের দু’টো দাঁড়ার মাঝখানে হাজারো ছটফট
করলেও তাদের ওড়ার স্বাধীনতা পায় না।
আর একটু গভীরে ভাবা
যাক! কে এই অসাধারণ কাজটা করে? ক্লিপের দু’খানা দাঁড়া আর একটা স্প্রিং, তাতেই কেল্লাফতে। কি দারুণ ব্যাপার না! ক্লিপের দু’দিকের কান ধরে চাপ না
দিলেই দু’টো দাঁড়া নিজেদের ধারালো দাঁত বের করে এক অন্যের দিকে তেড়ে যাবে। শিকার
না পেলে দু’টো দাঁড়া নিজেরাই নিজেদের দু'দিক থেকে সমস্ত
শক্তি দিয়ে চেপে ধরবে। যতক্ষন তুমি ক্লিপের কানদু’টো ধরে থাকবে ততক্ষণ তারা কিস্যু
করতে পারবে না। আর একটু অন্যমনস্ক হলেই...
এবার ভাঙা ক্লিপটার পাশে পড়ে থাকা স্প্রিংটাকে দেখলাম। পাকানো শক্ত চেহারা। দুইপ্রান্তে দু’টো লোহার শলাকা বেরিয়ে আছে। থাকে স্প্রিংয়ের আড়ালে। আসলে সমস্ত শক্তিই আছে ওই গোটানো দড়িপাকানো চেহারাটায়। ক্লিপের কান ছেড়ে দিলেই স্প্রিংয়ের আদেশে হাঙরের মতো তীক্ষ্ণ দাঁতওয়ালা দু’টো চোয়াল পূর্ণশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে টুঁটি চেপে ধরার জন্য।কি জানি কেন, ক্লিপটাকে জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেবার আগে মনে হলো আমাদের দেশের সরকার কি আজকাল ওইরকম ক্লিপের মতো হয়ে গেছে। না, না আজ নয়। চিরদিনই ছিল। কানদু’টো আচ্ছা করে ধরে না রাখলেই স্প্রিং-পুলিশ দিয়ে সরকারি দাঁড়াগুলো জনগণের টুঁটি চেপে ধরার আশায় ওৎ পেতে বসে থাকে।
তখনই মেয়ের মায়ের গলা
ভেসে এলো। ভাঙা ক্লিপটা নিয়ে কি গবেষণা করছ? এদিকে এসে মেয়েটাকে একটু ঘুম পাড়াতে পারছো
না! তারপরেই বিড়বিড় করতে শোনা গেল, সারাদিন কাজের কাজ যদি
কিছু করে...
আরো কি সব বলতে বলতে
সে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল। আমি শুনতে পাই নি।
1 টি মন্তব্য:
Daruun.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন