গত কয়েক সপ্তাহ ধরে
এক ভীষণ টানাপোড়েন চলছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে রাজ্যগুলোর
রাজধানী আর বড়-মাঝারি শিল্পতালুকগুলিতে যেখানে প্রায় ২০ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক তাদের
পরিবারসুদ্ধ আটকে পড়েছেন গত দু’মাসের বেশী সময় ধরে।
লকডাউন শুরু
হওয়ামাত্র সরকার প্রথমেই তাদের আটকে দিল। কি না তারা ফিরে
গেলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পারে। বাস, ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল। তবু কেউ কেউ পায়ে
হেঁটে পাড়ি দিল নিজের গ্রামের দিকে। যা থাকে কপালে। হাজার হাজার মাইল পায়ে হেঁটে
তাদের অনেকেই পৌঁছাল। আবার অনেকের ক্ষীণ প্রাণটুকু অনাহারে, অবহেলায়
শেষ হয়ে গেল রাস্তাতেই। যারা আটকে পড়ল তারা আধপেটা খেয়ে, পুলিশের
লাঠি খেয়ে, নিত্য অপমান সয়ে কোনরকমে প্রাণটুকু জিইয়ে রাখল।
শেষমেশ এতদিন পরে
সরকার হটাৎ জেগে উঠেছে। অনেক সাধ্য-সাধনার পর রাজী হল কিছু ট্রেন চালানোর। কিন্তু
ভ্রমণের ভাড়া দেবে কে?
প্রথমে সরকার রেল
পরিযায়ী শ্রমিকদের ভাড়া দিতে চাইছিল না। অথচ হেলিকপ্টার থেকে হাসপাতালের উপর ফুল
ছড়ানোর জন্য অর্থের অভাব হল না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তারা পৃথিবীর রেকর্ড-ভাঙা
মূর্তি বানিয়েছে। দেশের উন্নতির নামে শিল্পপতি আর ধনকুবেরদের
জন্য বাজেটে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকার উপঢৌকন দেওয়া হয়েছে। কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে কেউকেটা মানুষজন ট্রাম্প-সাহেবের
সাথে করমর্দন করলেন, গুনে গুনে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কোলাকুলি করলেন।
সেইসব ছবি দেশ-বিদেশের কাগজের প্রথম পাতায় ছেপে বেরোল। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!
এখন নাকি কোষাগার
শূন্য। সরকার কি করেছেন। মাত্র একমাস দেশের কয়েক কোটি গরীব মানুষকে বিনামূল্যে খাবার
দিয়েছেন। অবশ্যই হাত ধোবার সাবান দিয়েছেন! আর তো কিছু পড়ে নেই বাছা। ওদিকে সেই শিল্পপতিরাও উচ্চস্বরে “ত্রাণ চাই, ত্রাণ
চাই” বলে পরিত্রাহী চিৎকার করতে শুরু করেছেন। কারখানা এক-দেড়মাস বন্ধ রয়েছে বলে তাঁদের নাকি কাছা খুলে পড়েছে।
এ তো বিশাল
টানাপোড়েন। শ্যাম রাখি না কুল রাখি। এক অভূতপূর্ব ধর্মসঙ্কট।
তাই যে দেশে গভীর
রাত্রে সরকার বদলে যায়, গোপনে পাস হয়ে যায় অর্ডিন্যান্স, সে দেশের সরকারের “মনের
কথা” জনগণ জানুক না জানুক, বোঝে তো বটেই। তাই সরকার প্রথম থেকেই শ্রমিকদের নিজেদের
বাড়িতে পাঠানোর ব্যাপারে টালবাহানা করেছে। অথচ রাজস্থানের ‘কোটা’ থেকে পড়ুয়াদের,
অন্যান্য জায়গা থেকে ভ্রমনার্থীদের কিংবা চিকিৎসা করতে গিয়ে আটকে
যাওয়া রোগীদের পাঠাতে কোনো বিলম্ব হয়নি।
তাহলে? এইসব
পড়ুয়া, রোগী কিংবা ভ্রমনার্থীরা কেউ শ্রমিক নয় বলে? ঠিক ধরেছেন। লকডাউন উঠে গেলে কারখানা চালু হতে পারে। সে যতখানি চালু করা যায়
যাক না কেন। এদিকে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে গেলে সেইসব কল-কারখানা, নির্মাণশিল্প, কাপড়ের কারখানায় কিংবা সুরাটের হিরে-কাটা শিল্পে কাজ করবে
কে? শ্রমের জোগানে টান পড়লে, মজুরি বাড়বে আর
মুনাফায় টান পড়বে যে! ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কারখানা, উৎপাদন, মুনাফা - এই সবগুলোকে কে চালায় আর অনন্ত যুগ ধরে কে দেয় মুনাফার যোগান?
তারা হল এইসব পরিযায়ী
শ্রমিকেরা। তারা কেবলই শ্রমিক। সরকার কিংবা মালিক, কেউ
তাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, এই অতিমারীর সময়ে সেই কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। এদেশে তারাই
হল সবচেয়ে কম মজুরির শ্রমিক। যাদের অভাব আছে, খিদে আছে, সংসার আছে, জীবন আছে অথচ দক্ষতা নেই, শিক্ষা নেই, দরাদরি করার এলেম নেই। দেশের কোন শ্রমিক সংগঠন তাদের সদস্যও করে না। অথচ এই শ্রমিকেরাই দেশের
ছোট-বড়-মাঝারি কারখানা থেকে শুরু করে মাঠে-ঘাটে-বন্দরে কিংবা বিশাল অট্টালিকা তৈরী
করতে একমাত্র অক্সিজেন। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় এরা শ্রমের ন্যায্য মজুরি
পায় না। আজ পর্যন্ত পায়নি।
দেশের বাকি লোকজন কোথায়
গেল? সেইসব সদা হাস্যমুখ নেতা, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানী, বিচারক, উকিল -
যারা নাকি সর্বক্ষন দেশের মুখ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেন!
এখন কেউ নেই। সরকার থেকে শুরু করে সেইসব নাগরিকজন, ন্যায় নিয়ে পৃথিবী তোলপাড় করে দেওয়া বিচারক, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, সবাই এখন নির্বাকের ভূমিকা অভিনয় করছেন। সেইসব সাধু-সন্তরা, যাঁরা রামমন্দির সমস্যার সুষ্ঠু (?) মীমাংসা করতে উদগ্রীব ছিলেন কিংবা সেই সব পদ (নাকি চেয়ার?) আলো করে বসে থাকা বিচারক আর আইনজীবিরা, যাঁরা এক দৌড়ে চলে যেতে রাজি হন শাহিনবাগের আন্দোলন ভাঙার জন্য, তাঁরা গেলেন কোথায়? কোথায় গেলেন তিনি, যিনি কয়েকযুগ ধরে চলতে থাকা মামলাটির তড়িঘড়ি করে ৪০ দিন একটানা জেরা চালালেন, যাতে অবসর নেবার আগেই মামলার চূড়ান্ত রায় দিয়ে যেতে পারেন। কারণ তখন রাজ্যসভার একটি আসন শূন্য পড়ে ছিল। যুগ যুগ ধরে নীতি-নৈতিকতার ধ্বজাধারী সেই সব ব্যক্তি-মানুষ, সংস্থা, তথাকথিত সামাজিক, ন্যায়বাদী আর মানবাধিকার নিয়ে দিবারাত্র চেঁচাতে থাকা সংগঠনগুলো - সবাই এখন নিশ্চুপ। তাঁরা লকডাউনে ঘরে আছেন বলে তাদের নীতি-নৈতিকতা, বুলি আর প্রতিবাদ, সব এখন গভীর জলের তলায়।
আসলে এনারা সবাই
সর্বব্যাপী ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এক-একটি নাটবল্টু মাত্র। তবে সেই নাটবল্টু তখনই
সচল হয় যখন তাঁদের স্বার্থের চামড়ায় গরম ছ্যাঁকা লাগে। তার আগে এরা সবাই
শান্তশিষ্ট, আইনমান্যকারী, নিরীহ সাধারণ
জনগণ। আপাত কোন স্বার্থ
ছাড়াই তারা এই গরীব, নিঃস্ব, সম্বলহীন পরিযায়ী
মানুষগুলির জন্য কাঁদতে যাবেন কেন! সেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভুরা, যাদের বিপুল সম্পদ আর মুনাফা শ্রমিকদের শ্রমকে “কিনেছে অল্পদামে”, তাঁরা দৌড়ে এসে টুঁটি টিপে ধরবে না! বলবে, ফিরিয়ে
দাও তোমার পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ। তাহলে কি হবে! এত ক্যামেরা, এত
আলো, এত ফুলের তোড়াগুলোর কি হবে!
অবশেষে একটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক
দল সেই শ্রমিকদের ভাড়া মেটাবার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই সরকার নড়েচড়ে বসেছে। অনেক ঢোঁক
গিলে নিমরাজি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ক্ষমতা যে ধরে রাখতেই
হবে। যেনতেনপ্রকারেণ। ভোট যে বড় বালাই।
তবে আগামীদিনে আরো বড়
ধাক্কা আসতে চলেছে। এইসব পরিযায়ী মানুষদের নূনতম সুরক্ষা দেবার যে আইন ১৯৭৯ সালে
থেকে চালু আছে, সংসদে পেশ হওয়া নতুন বিলটি আইনে পরিণত হলে সেটুকুও
আর থাকবে না। কাজের জায়গায় শ্রমিকদের নথিভুক্ত করা, তাদের
পরিচয়পত্র দেওয়ার মতো বিষয়গুলো বাদ পড়ে গেছে। করোনা-সঙ্কটের এই দুর্দিনের মধ্যে এই
শ্রমিকরা হয়তো আইনের রক্ষাকবচটুকুও হারাতে চলেছেন।
হে গরীব! তোমাদের
জন্য ভগবান, আল্লা, যিশু কেউ ভাবে না। কবে
তোমরা উঠে দাঁড়াবে? কেড়ে নেবে তোমার জন্মগত অধিকার!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন