প্রাথমিক
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরেই একটি মর্মান্তিক খবর আমরা
সবাই পড়েছি। দক্ষিণ
দিনাজপুরের এক শিক্ষকের চাকরি প্রার্থী, যিনি নিজেই একটি
রাজনৈতিক দলের একজন সদস্য, তবু কয়েক লক্ষ টাকা নাকি
দিয়েছিলেন স্কুলের চাকরি জোগাড় করার জন্য। বলাবাহুল্য টাকাটি তিনি কাউকে দান করেন নি। স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পাবার জন্য ঘুষ দিয়েছিলেন। ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা আজকাল হামেশাই শোনা যায়। অমুক চাকরির জন্য এত টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে, তমুক আধিকারিক ঘুষ নিতে গিয়ে বামাল ধরা পড়েছেন। মাঝে মাঝেই কাগজে রেল-দপ্তরের বিজ্ঞাপনও দেখা যায়। কেউ যেন মনে না করেন ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া যায়
ইত্যাদি, ইত্যাদি। যদিও কোনটা যে
সত্যি সেটা এখন আর কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না।
এটা
কোন অবিশ্বাস্য খবর নয় যে কেউ কেউ ঘুষ দিয়ে চাকরি পান। কোন কোন ক্ষেত্রে সঠিক পাদপদ্মে নৈবেদ্য পৌঁছে দিতে পারলেই নাকি চাকরি
পাওয়া যায়। সে সরকারি
কিংবা বেসরকারি - সব ক্ষেত্রেই হয়। সরকারি
ব্যাপারে লোকে একটু বেশী উদ্বেল কিংবা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কারণ জনসাধারণের ধারণা সরকারি টাকা জনগণের টাকা। তাই সরকারি চাকরিতে সবারই নীতিগতভাবে সমান অধিকার। কেউ ঘুষ দিয়ে পেয়ে গেলে গাত্রদাহ হবারই
কথা। বেসরকারি চাকরি পাওয়ার জন্যও লোকে ঘুষ দেয়। তবু সেটা নিয়ে লোকে মাথা ঘামায় না। যেন বেসরকারি ক্ষেত্রে যারা ঘুষ নেয় কিংবা দেয় তারা কেউ চরিত্রহীন নয়। বেসরকারি টাকায় কি তবে ন্যায়-নীতির বালাই নেই!
গত
কয়েকদিন ধরে সমস্ত কাগজেই একটাই সংবাদ। এ
রাজ্যে সদ্য সমাপ্ত স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় বিপুলাকায় দুর্নীতি হয়েছে। আগেও যে এমন দুর্নীতির ঘটনা শোনা যায়নি তা নয়। তবে এবারের মতো এত সংগঠিত ও সুচারুরূপে ঘুষ
দেওয়া-নেওয়া হয়েছে যে, তা এক কথায় অভাবনীয়। চাকরি
পাবার জন্য হবু মাস্টারেরা লাখ-লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন নিজ-নিজ অঞ্চলের কিংবা জেলার
রাজনৈতিক নেতাদের। সেইসব নেতাদের
সুপারিশ মতো চাকরিপ্রার্থীদের তালিকা পৌঁছে গেছে সঠিক জায়গায়। তার ফলে কেউ হয়তো পরীক্ষায় পাশ না করেও চাকরি পেয়ে গেছেন। কেউ পাশ করেছেন আবার টাকাও দিয়েছেন। সাবধানের মার নেই, এই ভেবে। পরে আরো বেশী টাকা দিয়ে “চাকরি” নিজের বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে টেনে
এনেছেন। আবার কেউ কেউ টাকা দিয়েও চাকরি পান নি। বলাবাহুল্য শেষোক্ত দলভুক্তরাই সংখ্যায় বেশী এবং
তারাই এখন তথাকথিত “বিচার চাইতে” আন্দোলনে নেমেছেন।
এদেশে
এর আগেও অনেক দুর্নীতির খেলা ফাঁস হয়েছে।
কমনওয়েলথ খেলায়, ২জি স্পেকট্রাম নিলামের সময়, সাবমেরিন
কেনার সময় কিংবা ‘বিশ্ববিখ্যাত’ বোফর্স দুর্নীতি। এর পাশাপাশি আমরা দেখেছি মধ্যপ্রদেশে ডাক্তারী ও সরকারি চাকরি পাওয়া
নিয়ে “ব্যাপম” দুর্নীতির ঘটনা কত ব্যাপক আর ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাই দুর্নীতির খবরগুলো এখন হয়তো আমাদের চেতনায় আগের মতো আর জোরালো
ধাক্কা মারে না। তাই এইসব
দুর্নীতি নিয়ে এত হট্টগোল, স্লোগানের আর চাপান-উতরের মাঝে একটা কথা
মনে হয় আমরা যেন ভুলতে বসেছি। সেটা
হলো,
এদেশে কিংবা এ-রাজ্যে ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়, এটাও আমাদের দেখতে হলো।
এবার
কাগজখানা কিছুক্ষণের জন্য চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখে একটুখানি ভাবুন তো, আমরা
ছোটবেলা থেকে কি কি শিখে এসেছি।
শিশুকাল থেকে সমস্ত পৃথিবী আমাদের পই পই করে শিখিয়েছে যে বাবা-মায়ের পরেই
শিক্ষক-শিক্ষিকার সম্মানীয় স্থান।
জীবনদানের পরেই মহৎকাজ হলো শিক্ষাদান।
বাবা-মা আমাদের পৃথিবীর আলো দেখান আর শিক্ষাগুরু সেই পৃথিবীতে অজ্ঞানতার কালো
ঘুচিয়ে শিক্ষার আলো দেখান। আর এত
কিছুর পরেও এই “ঘুষ দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি”, এই শব্দগুচ্ছগুলোর অভিঘাতে কি আমাদের
এতদিন ধরে শেখা ঝুড়ি ঝুড়ি নীতিজ্ঞানের পাহাড় তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে না!
ঘুষ
দিয়ে সদ্য যারা শিক্ষকতার চাকরি পেলেন, অল্প কিছুদিন পরেই তারা
বিভিন্ন স্কুলে পড়াতে শুরু করে দেবেন। শ্রেণীকক্ষে মাস্টারমশাই ঢোকামাত্র চিরাচরিত মূল্যবোধের অভ্যাসে একদল
সহজমতি,
নিষ্পাপ, সরল শিশুর দল উঠে দাঁড়িয়ে তাদের
সম্মান দেখাবে। পাহাড়-প্রমাণ শ্রদ্ধা
আর অনন্ত প্রত্যাশা নিয়ে শিশুর দল তাকিয়ে থাকবে সেই শিক্ষাগুরুর মুখপানে। অসীম আগ্রহে আর পরম বিশ্বাসে তারা জানে
এই শিক্ষক-শিক্ষিকারাই তাদের হাত ধরে অজ্ঞানতার, অশিক্ষার আর নির্দয়
পৃথিবীর নিষ্ঠুর হাত থেকে সসম্মানে বেঁচে থাকার পথ দেখাবে, সাহস
জোগাবে। অথচ সেই শিশুর
দল জানেই না যে “শিক্ষাদানের প্রামান্য যোগ্যতা” না থাকা সত্ত্বেও তাদের
শিক্ষাগুরু “চরম মিথ্যাচার” অবলম্বন করে শিক্ষকতার পদটি জোগাড় করেছেন।
এরাই
বা কেমন শিক্ষক? যিনি নিজে তো জানেনই, তার আত্মা
জানে, পরিবার জানে, তাঁকে যারা
ভালোবাসে কিংবা ঘৃণা করে তারাও জানে, পাড়া-প্রতিবেশী জানে
এবং খোদ সরকার জানে যে তারা শিক্ষকতার চাকরিটি হস্তগত করেছেন কয়েক লক্ষ টাকা ঘুষের
বিনিময়ে। কোন যোগ্যতায়
তারা ক্লাসে এসে ভবিষ্যতের নাগরিকদের পড়াবেন? কোন চরিত্রবলে দীক্ষিত
হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের চারিত্রিক শিক্ষা দেবেন? কোন সত্যের উপর
ভর করে ভালো-মন্দের ফারাক বুঝিয়ে দেবেন কিংবা সৎ নাগরিক হবার জ্ঞান দেবেন? এগুলো ভাবলেই প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। খুব, খুব কষ্ট হচ্ছে আজ। কোন মুখে সেই ‘অসৎ’ শিক্ষকেরা সেই সব নীতিকথা বলবেন যাঁদের
নিজেদের সমস্ত আত্মা কলঙ্কিত, বিবেক ভূলুণ্ঠিত আর চরিত্র
মিথ্যাচারে ভরা।
আর
আমরা?
সেই শিশুদের বাবা-মা? আমরা কোন ভরসায় আমাদের
প্রাণাধিক সন্তানদের সেই শিক্ষকদের কাছে পাঠাবো। যখন আমরা জানি সেইসব শিক্ষকদের অনেকেই টাকা দিয়ে চাকরি কিনেছেন। শুধু তাই নয়। টাকার
দেবার সাথে সাথে তারা শিক্ষা-দীক্ষা, মান-সম্মান সমস্ত কিছু
বিকিয়ে দিয়েছেন সরকার চালানো একটা রাজনৈতিক দলের মুষ্টিমেয় কিছু হাঙরের কাছে। পরবর্তীকালে সেই সব রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা
হাঁক পাড়লেই তাঁরা যখন-তখন ক্লাস ফেলে “বুকে ভর দিয়ে” সুড়সুড় করে পার্টির মিছিলে
যাবেন,
ব্রিগেডের সমাবেশে মাঠ ভরাতে আসবেন, রাতের
গোপন অন্ধকারে পার্টির হয়ে দেওয়াল লিখবেন কিংবা সালিশি সভায় পার্টির স্বার্থে ঘাড়
নাড়বেন।
তার চেয়েও বড় কথা এইসব দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষেরা শিক্ষকের পোষাক পরে সমাজকে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত করবেন। যে টাকা তিনি ঘুষ দিয়েছেন (তাদের কথায়, বিনিয়োগ করেছেন – “শিক্ষকতা” নামক ব্যবসায়), সেই টাকা যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সুদে-আসলে উদ্ধার করতে চাইবেন। এটাই মনুষ্যধর্ম। তাই কিছু সরকারি ডাক্তার, যারা হাসপাতালে না গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি প্রনামীর বিনিময়ে নিজের চেম্বারে রোগী দেখেন, ঠিক সেই রকম এই “ভুয়ো শিক্ষকেরা” স্কুলে না পড়িয়ে ছাত্রদের প্রলুব্ধ করবেন তাদের বাড়িতে গিয়ে টিউশন নেবার জন্য। কেউ আর্থিক কারণে না নিতে পারলে কিংবা নৈতিক কারণে টিউশনি না নিতে চাইলে সেইসব ছাত্র-ছাত্রীদের তারা ক্লাসে এসে দিনের পর দিন অপমান আর হেনস্থা করবেন। কারন তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থকে পুনরুদ্ধার করতে হবে যে! এছাড়া আরো আছে। টাকার বিনিময়ে তাদের কাছে টিউশন পড়া ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে “আগামীকালের” প্রশ্নপত্র তুলে দেবেন পরীক্ষার আগের দিন (কলকাতার দুটি স্কুলে সদ্য এই কেলেঙ্কারি ধরা পড়েছে)। এইসব “শিক্ষকদের” কাছে নীতি-দুর্নীতির বালাই তো নেই।
এখন
প্রশ্ন হলো তাহলে কি আমাদের সমাজ এটা মেনেই নিয়েছে যে, শিক্ষকতার চাকরিও ঘুষ ছাড়া হয় না? শিক্ষকতার মতো
একটি মহান পেশা, সেখানে শিক্ষাগত এবং কারিগরি যোগ্যতাই
একমাত্র বিবেচ্য হওয়া উচিত নয় কি? কোথায় গেল আমাদের সেই
বুদ্ধিজীবি মুখগুলো যাঁরা মানুষের প্রতি অন্যায় আর অত্যাচার থামাতে পথে নামেন,
অনশন করেন। কোথায় গেল সেই
সব রাজনৈতিক নেতারা যারা নেতাদের ঘুষ নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসার পর বিধানসভা থেকে
শুরু করে রাস্তা-ঘাট অবধি দিনের পর দিন অচল করে রাখেন। কোথায় গেল সেই সব নেতা-আমলা-মন্ত্রীরা যারা এত বড় একটা দুর্নীতির কথা
জেনেও সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে শিক্ষার অবমূল্যায়ন নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দেন।
দুঃখের
বিষয় সরকারের একাংশ এই বিপুল দুর্নীতিতে সমান অংশীদার। যোগ্য প্রার্থীদের মেধা তালিকা এক ঝটকায় প্রকাশ করা হয় নি ( জয়েন্ট
পরীক্ষায় দুই লক্ষাধিক ছাত্রের ফলাফল প্রকাশিত হয় কোন সমস্যা ছাড়াই), নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় দফায় দফায় সেই তালিকা
প্রকাশিত করা হয়েছে। প্রশাশনের
কি কোন দায় নেই? নাকি তাদের একমাত্র দায় যেন তেন প্রকারেণ ভোটবাক্স
ভরাতে হবে। তাই কি তারা
সরকারি নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এবার প্রার্থীদের কাউন্সেলিংয়ে ডেকেছে। নিয়োগ পরীক্ষায় কি স্বচ্ছতার কণামাত্র অস্তিত্ব
থাকতে নেই? তাই নিয়ে অবশ্য তাদের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। আগামী বছর পঞ্চায়েত নির্বাচন। নির্বাচন-কমিশন দেশের সমস্ত নির্বাচনে টাকার খেলা
বন্ধ করতে আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। তাই
আগেভাগে তহবিল জোগাড় করাই আসলে এদের ধ্যান-জ্ঞান। সমাজ, সমাজের বৃহত্তর ভালো-মন্দ,
শিক্ষা-ব্যবস্থা, ন্যায়-নীতি, মতাদর্শ সব গোল্লায় গেলে যাক। সে সব নিয়ে তারা ভাবতে যাবে কেন! শেষমেশ ভুগবে তো
সাধারণ মানুষ।
তাই
এবার আপামর জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবি, সরকার
কিংবা আমলা - সবাইকে একটা প্রশ্ন করতে বড্ড ইচ্ছে করছে। এরপর কোথাও যদি শোনা যায় যে রাজ্যের কোন স্কুলের
কিছু ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় পাশ না করতে পেরে স্কুলের সামনে অবস্থান বিক্ষোভে
নেমেছে কিংবা “জোর করে পাশ করানোর” জন্য আন্দোলন শুরু করেছে কিংবা কোন
শিক্ষক-শিক্ষিকাকে তারা অসম্মান করেছে কিংবা সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলছে, “ভালো-মন্দ আর নীতিজ্ঞানের কথা আমাদের শোনাতে আসবেন না” - তাহলে তখন
আপনারা কার দিকে আঙুল তুলবেন সেটা ঠিক করে ভেবে দেখুন।
নাকি,
শুধু রাজা নয়, আমরা সবাই এখন উলঙ্গ!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন