দ্রুত বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসছে।
মরদ সেই কাকভোরে কাজে বেরিয়ে গেছে। ঘন্টাখানেক পরেই বাড়ি ফিরবে। বাড়ি বলতে এখন রেললাইন
থেকে একটু দূরে একচিলতে জমিতে প্লাস্টিকের একটা ছাউনি। ফিরে এসেই সে ভাত খেতে চাইবে, অথচ ঘরে চাল বাড়ন্ত। শেফালি তাই দৌড়ে
চলে এসেছে রেশনের দোকানে। এদিকে সন্ধে হলেই দোকানদার
ঝাঁপ ফেলে দেবে।
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে শেফালি এসে
দেখল দোকানের সামনে বিশাল ভিড়।
অন্যদিন এত লম্বা লাইন তো থাকে না! এত মানুষের ভিড় ঠেলে যতক্ষণে
সে সামনে পৌঁছবে, তখন যদি আর চাল না দেয়? এখন
তো আর শুধু রেশন-কার্ড দেখালেই হয় না। একটা যন্ত্র আছে, সেটাতে
ওরা আঙুলের ছাপ নেবে। সই করাবে। তারপর রেশন দেবে। অনেক ঝক্কি
আছে।
শেফালি রেশন-কার্ড আর ব্যাগ হাতে
আরও একটু এগিয়ে গেল। দোকানের ভেতর একটা টিভি চলছে। ভিড়টা সেখানেই বেশি। বুড়ো-বাচ্চা
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বেশিরভাগ সময় টিভিতে সিনেমা চলে। তখন
আশেপাশের দু’-চারজন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে। কিন্তু
এখন টিভির পর্দাটা কালো লাগছে। সোনালি রঙয়ের ছোট্ট কিছু একটা পর্দার মাঝখানে দুলছে।
শেফালির সামনে এখন মাত্র একজন
দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে আজ সে-ও রেশন পেয়ে যাবে। একটি ছেলেকে শেফালি জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ-রে বাপ, তোরা
কি দেখছিস সবাই?”
ছেলেটি তখন বিরাট উত্তেজিত। ভ্রূ
কুঁচকে শেফালির দিকে একবার তাকাল। তারপর টিভির
পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “মাসি চাঁদ দেখাচ্ছে। চাঁদ।”
শেফালি একটু অবাকই হল। টিভিতে
এখন চাঁদ দেখাচ্ছে? এই তো আজ বাদে কাল পূর্ণিমা। রাত হলেই তো সবাই
চাঁদ দেখতে পাবে। সে ছেলেটিকে বলল, “আকাশের দিকে তাকালেই তো হয় বাপ।”
“না গো মাসি। গতমাসে ইণ্ডিয়া
একটা চন্দ্রযান পাঠিয়েছিল। সেটা একটু পরেই চাঁদের মাটিতে গিয়ে
পোঁছাবে। বুঝলে কিছু?”
গতমাসেই তো সরকারি বুলডোজার এসে
রেললাইনের পাশে তাদের বস্তির সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। পুলিশ বলে গেছে শেফালিরা
নাকি ওখানে এতদিন বেআইনিভাবে বাড়ি তৈরি করে ওখানে থাকত। অথচ
বিয়ের মাসখানেক পরেই তারা ওই বাড়িতে এসে উঠেছিল। বড় মেয়েটা তো আর ক’মাস
পরেই তেইশে পড়বে। শেফালি আবার রেশন-কার্ডটার দিকে তাকাল। ভেঙে দেওয়া ওই বাড়িটার ঠিকানাই
তো এখনও কার্ডে লেখা আছে।
শেফালি সত্যিই কিছু বুঝতে পারল
না। দোকানে আসার পথে সে কয়েকটা আলু আর লঙ্কাও কিনে নিয়েছে। মাইনে পেতে এখনও অনেকদিন বাকি। তবে মরদ তার গরম মাড়-ভাতে একটু
আলুসেদ্ধ আর লঙ্কা পেলেই খুশি। হাপুস-হুপুস করে খেয়ে নেয়।
শেফালি ব্যাগটা দোকানদারের সামনে
এগিয়ে দেবার সময় হঠাৎই সবাই একসাথে বিশাল চিৎকার করে উঠল। কেউ কেউ দু’হাত
তুলে লাফাচ্ছে। কেউ হাততালি দিচ্ছে আর বলছে, “নেমে গেছে। নেমে গেছে।”
শেফালি এবার
দোকানদারকেই জিজ্ঞেস করল, “দাদা, ওরা
এত লাফাচ্ছে কেন?”
দোকানদার শেফালির ব্যাগে চাল ঢেলে
দিতে দিতে বলল,
“দিদি, ওরা যে দু’বেলা
পেট ভরে খেতে পায়।”
চাল-ভর্তি ব্যাগটার মুখে গিঁট দিতে দিতে শেফালির বুক থেকে একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস
বেরিয়ে এল। সে বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল। মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাপকলে জল আসার সময় হয়ে এসেছে যে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন