বসন্ত এসে গেছে!

শীত বিদায় নিচ্ছে। ভোরবেলার বাতাসে একটু শিরশিরে ভাব। তাই ঘুমের ঘোরে চাদরটা গায়ে টেনে নিলে নিদ্রাভঙ্গের পরেও আরামের রেশটুকু মনে কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু অফিস যাবার তাড়া। তাই সকালের কাগজটাকে বগলদাবা করে সোজা প্রাতরাশের টেবিলে।

কয়েকদিন ধরেই জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করার পর থেকেই তুমুল আলোড়ন শুরু হয়েছে। এমন গনগনে আগুন, এদেশে, বিদেশে এমনকি এ-রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আঁচ এসে পড়েছে। মাঝখান থেকে, যতদিন যাচ্ছে কে দেশপ্রেমিক আর কে যে নয়, সবকিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হটাৎ! কেন?



সকালের কাগজ দেখেই আক্কেল-গুড়ুম! যাঁরা রেডিও-টিভি-ইন্টারনেট খুলেছেন, তাঁরা অবশ্য আগেই জানেন। গত বুধবার আদালতে নিয়ে যাবার পথে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অগ্রাহ্য করেই, আদালতের চৌহদ্দির মধ্যে পুলিশের সামনে যে ভাবে কানহাইকে, সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের, বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শীদের এমনকি সর্বোচ্চ আদালতের পাঠানো প্রতিনিধি বিশিষ্ট বিচারপতিদের শারীরিকভাবে ও অকথ্য গালাগালি দিয়ে যেভাবে হেনস্থা করা হলো, তার নজির বোধহয় এ দেশের ইতিহাসে কোথাও নেই। এমনকি সর্বকালীন কুখ্যাত জরুরি অবস্থার সময়েও হয় নি।

কারা করল? “কালো” কোট পরা একদল আইনজীবী। তারা নাকি সকালে ফেসবুকে হুমকি প্রচার করে, হাতে জাতীয় পতাকা উঁচিয়ে (পতাকার ডান্ডাগুলো কি মজবুত ছিল লক্ষ্য করেছেন?) আর 'বন্দে মাতরম' স্লোগান সহ সবাইকে বেধড়ক পিটিয়ে দিল। পূর্বঘোষনামতো, পরিকল্পিতভাবে এবং নির্বিঘ্নে। আর সেখানে মোতায়েন পুলিশবাহিনী! তারা আইনের রক্ষক। কি করছিল? গায়ে সরকারী খাকি পোষাক পরে ‘ধৃতরাষ্ট্রের’ ভূমিকায় অভিনয় করলো। এমনকি দিনের শেষে দিল্লি পুলিশের বড়কর্তা একটি ছেঁদো যুক্তি দিয়ে তাঁর অধস্তন সহকর্মীদের পিঠ চাপড়ে দিলেন।
এরপরেও কি মনে হতে পারে তথাকথিত এই আইনজীবীরা পাড়ার স্থানীয় গুন্ডা-লুম্পেনদের থেকে কিছু আলাদা জাতের? তারা সাদা পোষাকে তোলা আদায় করে, না পেলে উত্তম-মধ্যম দেয়। আর যখন কিছু গুন্ডা-লুম্পেন আইনজীবীর দল আইনের পিণ্ডি চটকে দেয়, তখন কি একবারের জন্যও আমাদের শিরদাঁড়ায় বরফের স্রোত বয়ে যায় না!
**

সকালবেলা। ঘড়ির কাঁটাগুলো সব পাল্লা দিয়ে দৌড়চ্ছে। প্রাতরাশের টেবিলে বসে চোখে পড়লো একটা ছোট্ট খবরে। ২০১৬ সালে, মাত্র এই দেড় মাসে মহারাষ্ট্রে ১২৪ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে। আর সেটা জেনে মহারাষ্ট্রেরই একজন সাংসদ বলেছেন, কৃষকদের এই আত্মহত্যা করাটা এখন একটা ফ্যাসান, চালু প্রবণতা। এর পরেও গলা দিয়ে পাঁউরুটির টুকরোগুলো কিছুতেই যেন নামতে চাইছিল না।

এবার কাগজ রেখে অফিসের ব্যাগ তুলতে যাবার আগে চোখে পড়লো আরেকটি ছোট্ট খবর। গত মাসে ছত্রিশগড়ের সুরগুজা জেলার ঘাটবারা গ্রামের আদিবাসীদের আইনপ্রাপ্ত জঙ্গলের অধিকার বাতিল করা হয়েছে। কেন? সেখানে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা কয়লাখনি চালু করবে। যদিও ‘অরণ্যের অধিকার’ আইন বলে, আইনগত ভাবে প্রাপ্ত জমির অধিকার আদিবাসীদের গ্রামসভার সর্বসম্মত অনুমতি ছাড়া কোনভাবেই বাতিল করা যায় না।

তখন কি আমাদের মনে এই প্রশ্ন উঁকি মারে না যে মানুষের জীবন ও সমাজ বিধ্বংসী এইসব “ব্রেকিং নিউজ” দেশবাসীর চোখের আড়ালে রাখার জন্যই কি হটাৎ করে দেশভক্তির জিগির তোলা হলো?

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাস আসার অপেক্ষার মাঝে হটাৎ মনে হলো বসন্ত কি তাহলে এসে গেছে!

কোন মন্তব্য নেই: